দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে যাওয়ায় ফের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি
আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা ভেঙে গেছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলেছে বলে মনে করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিবেকশূন্য হয়েছেন। তারা ক্ষমতাসীন দলের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করছেন। সরকারি কর্মচারীদের সিংহভাগ সরকারদলীয় কর্মীর মতো আচরণ করছেন। ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন এখন কল্পনায় পরিণত হয়েছে। ভোটাধিকার হারিয়ে মানুষ এখন রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছে সুশীল সমাজ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ মতামত দেন।
সংগঠনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে লিখিত প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। সূচনা বক্তব্য দেন নির্বাহী সদস্য ড. শাহদীন মালিক।
বৈঠকে অংশ নেন বিচারপতি এমএ মতিন, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রিয়াজ, সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, সৈয়দ আবুল মকসুদ, তোফায়েল আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলম, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সুজন সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার, সহসভাপতি ড. হামিদা হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য সিআর আবরার, একরাম হোসেন, নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দর খান, সফিউদ্দিন আহমেদ, আকবর হোসেন প্রমুখ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার তার লিখিত প্রবন্ধে বলেন, গণতন্ত্র হল জনগণের সম্মতির শাসন, যে সম্মতি প্রতিষ্ঠা হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তাদের প্রতিনিধিত্ব করার লক্ষ্যে বেছে নেয়। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতা জনগণের স্বার্থে ও কল্যাণে ব্যবহার করে। তবে বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ ভিন্ন, কারণ ক্ষমতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর অপব্যবহার ও কুক্ষিগতকরণ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কতগুলো প্রতিষ্ঠান- সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্সেস’ বা নজরদারিত্বের কাঠামো গড়ে তোলা হয়। এ নজরদারিত্বের কাঠামো কার্যকারিতা প্রদর্শন করলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কার্যকর হয়।
বদিউল আলম আরও বলেন, আমাদের সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে কয়েকটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব দিয়েছে। দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতাও দেয়া হয়েছে। নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতাও আমাদের উচ্চ আদালত কমিশনকে দিয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন বহু অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আমাদের নির্বাচন কমিশন ছিল সম্পূর্ণ নির্বিকার- অনেকগুলো গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তারা তদন্ত করেছে বলেও আমরা শুনিনি। এটি অনস্বীকার্য যে, সরকার ও রাজনৈতিক দল, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল না চাইলে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রায় অসম্ভব। এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও। তবে এক্ষেত্রে কমিশনের হতে একটি বড় অস্ত্র রয়েছে, যা হল নির্বাচন বন্ধ করে দেয়া। অনেকের ধারণা যে, একতরফা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে কাজী রকিবউদ্দিন কমিশন সাহসী ভূমিকা নিলে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসই হয়তো ভিন্ন হতো।
বদিউল আলম বলেন, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নূরুল হুদা কমিশনের সব ক্ষমতা থাকলেও সে ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে খুলনা, গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটি সুস্পষ্ট যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অসততা ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ আমাদের অসংখ্য নাগরিকের ভোটাধিকার হরণ করেছে। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের ব্যাপক আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে তারা ভোট দিতে চাইলেও ভোট দিতে পারবে না। আর ভোট দিলেও তারা ‘ফলাফল’ প্রভাবিত করতে পারবে না- যারা জয়ী হওয়ার তারাই জয়ী হবেন। কেন্দ্রভিত্তিক নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ থেকে আমরা দেখেছি, নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফল বহুলাংশে বানোয়াট। তাই এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাই আজ ভেঙে পড়েছে, যা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে ফেলেছে। এছাড়াও আমাদের রাজনীতি আজ বহুলাংশে বিরোধী দলশূন্য হয়ে পড়েছে, যার দায় অবশ্য আমাদের প্রধান বিরোধী দলও এড়াতে পারে না। ফলে বহু নাগরিকের মধ্যে আজ চরম অসন্তোষ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে।
শাহদীন মালিক বলেন, গণতন্ত্রের প্রকৃত ধারণার সঙ্গে আমাদের চারদিকে যে অবস্থা দেখছি তার কোনো মিল নেই। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান। কিন্তু তারা সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। এখনকার নির্বাচন যেন সত্তর-আশির দশকের নির্বাচনের মতো হয়ে গিয়েছে। গণতন্ত্র, নির্বাচন- এসব বিষয় ক্রমাগত কল্পনার বিষয়ে পরিণত হচ্ছে।
আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। এর মাধ্যমে এক ধরনের সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কে প্রধানমন্ত্রী, সেটা কোনো বিষয় না। নির্বাহী বিভাগের এই যে ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, এটাকে আলোচনা না করে শুধু কমিশন নিয়ে আলোচনা করলে আর হবে না।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশনের পেছনের শক্তি হল আদালত। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত কোনো আদালতকে কমিশনের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে দেখিনি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনাররা একটা আইনের মাধ্যমে নিয়োগ হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সেটা হচ্ছে না। তাই নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের আইন প্রণয়ন করে যাতে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, সেদিকে আমাদের জোর দিতে হবে।
আবু সাঈদ খান বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি কাজ করা দরকার বলে আমি মনে করি। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতায়ন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ এবং নির্বাচনী আইন পরিবর্তন করে এলাকাভিত্তিক নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করে একটা মিশ্র নির্বাচনী ব্যবস্থায় যাওয়া।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, নির্বাচনের প্রধান অংশীদার হল সরকার। কমিশন গঠনের জন্য যেসব সার্চ কমিটি গঠন করা হয় এগুলোতে সরকার যাকে চায় সেরকম লোকই বেরিয়ে আসে। মন্ত্রিপরিষদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকেও এটা দেখেছি। তাই সরকার না চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন করা খুবই দুরূহ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, নির্বাচন, গণতন্ত্র- এসব এখন কবিগান, ঘেটুগানের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে বহুদলীয় গণতন্ত্র নেই, সেখানে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা অর্থহীন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন একটি বিবেকশূন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তাদের বিবেকশূন্যতার কারণে নির্বাচন নিয়ে জনগণের আগ্রহ শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আগে জানতাম সামরিক শাসকরা বিরাজনীতিকরণ করে, একটা বেসামরিক সরকার যে এভাবে বিরাজনীতিকরণ করতে পারে, এখন আমরা তা-ও দেখতে পাচ্ছি। আমি সবাইকে বলব সামনে স্থানীয় সরকারের যে নির্বাচনগুলো আছে, সেগুলোকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য।
আবদুল লতিফ মণ্ডল বলেন, কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে না, নির্বাচন পরিচালনা করে মাঠপ্রশাসন। মাঠপ্রশাসন নিরপেক্ষ না থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। দীর্ঘদিন একই সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে নব্বই ভাগ সরকারি কর্মচারী দলীয় হয়ে পড়েছেন। কাজেই মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
আসিফ নজরুল বলেন, আমরা সবাই জানি কমিশন, প্রশাসন দলীয় অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছে- এটাই প্রধান সমস্যা। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা আবার ভালো মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। সুতরাং আমাদেরকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠনের কথা জোরেশোরে বলতে হবে।
দিলীপ কুমার সরকার বলেন, সাংবিধানিকভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন কী ধরনের ভূমিকা পালন করছে, তা আমরা সবাই অবগত।
এমএ মতিন বলেন, সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাজনীতি করা প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব। তাই এই অনুচ্ছেদকে সামনে এনে জনগণের মধ্যে প্রচার করার মাধ্যমে তাদেরকে সচেতন ও সংগঠিত করে তুলতে হবে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এখন যা হচ্ছে এগুলোকে নির্বাচন বলা যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমাদের একটা রূপরেখা তৈরি করা দরকার বলে আমি মনে করি।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আমরা অনেক কথা বলছি; কিন্তু যারা শোনার তারা শুনছেন না বা শুনলেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাই একটা ব্যাপক গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করা দরকার। তাহলে হয়তো কিছু হতে পারে। এজন্য আমাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।